-বেটি, একটু সাটাম করবা হবি। বেলাটা ডুবে গেল। -করছু বাবা। কুমড়ার বোটালা কাটছু। -বোটালা কাটতি হবি নি। দাওটা ভেন গাড়িত তুলে দে বেটি। বোটালা মুই কাটি লিম। কদম রসুল মাফলার দিয়ে কান আর মাথা জড়িয়ে বউয়ের বিছানার পাশে দাড়ায়। গত দুই মাস অজ্ঞাত রোগে শয্যাশায়ী। হাটা চলা করতে পারে না। রসুল খুব চিন্তায় আছে। বউটা মরে গেলে এই সংসার অচল হয়ে যাবে। এই সংসারটা চালায় ময়না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দশ হাতে কাজ করে। এখন মেয়েটার উপর চাপ বেড়ে গেছে। ময়নাকে সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলো সাত দিন আগে। ডাক্তার যে ওষুধ লিখে দিয়েছে টাকার অভাবে কেনা হয়নি। ওষুধের দোকানে জেনেছে সাত দিনের ওষুধ কিনতে হাজার দেড়েক টাকা লাগবে। ক্ষেতে কুমড়া গুলোতে সবে মাত্র রঙ ধরেছে। মাস খানেক ধরে রাখতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যেতো। উপায় নেই, বউটা না বাঁচলে বাড়তি লাভ দিয়ে কি হবে। ময়নার বালিশের নীচ থেকে ডাক্তারের লিখে দেয়া ওষুধের কাগজটি পকেটে ভরে নেয়। ময়নার গাটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। শুকনো জল পট্টি আরেকবার পানিতে ভিজিয়ে ময়নার কপালে চেপে দেয় রসুল। গামছা ভিজিয়ে মুখটা মুছে দেয়। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলে বার বার ভিজে যাচ্ছে ময়নার মুখটা। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হয় রসুল। বাড়ির পূর্ব পাশে কুমড়া ক্ষেতের দিকে যায় রসুল। কোহিনুর দুইটা ভেনে মন দশেক কুমড়া তুলেছে। দুশ টাকা মন হলে হাজার দুয়েক টাকা তো হবেই। ওষুধ কিনে বাড়তি কিছু টাকা হাতে থাকবে। বিকেলের রোদ ভেন গাড়িতে রাখা মিষ্টি কুমড়ার গায়ে লেগে সোনার মতো জ্বলছে। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে খুব মায়া হয় রসুলের। সংসারের এতোটা চাপ পড়েনি কোন দিন। আজ কোহিনুরের মুখটা বাবার চোখে অনেক বেশী ঝলমল করছে। বিকেলের রোদে কুমড়ার মতো মেয়েটার মুখেও যেন সোনা রং ধরেছে। বাবারা নিজের কন্যার বয়স হলে বুঝতে পারেনা। মায়েদের মনে করিয়ে দিতে হয়। ময়নার হয়তো বলবে স্কুলটা পাশ দিলে কোহিনুরের জন্য ভালো একটা ছেলে দেখো। ঢোলার হাট আড়তে কুমড়া বিক্রি করে রুহিয়া বাজার যেতে হবে। এখানে সব ওষুধ পাওয়া যায় না। রসুল পিছনের ভেন গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে মজুকে বলে -ভেনডা দৌড়ে যা। এমন সময় কোহিনুর পিছন থেকে ডাকে -আব্বা থাকিস। কোহিনুর দৌড়ে বাড়ি থেকে একটা বোতল আর এক জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে ফিরে এসে। বাবার পায়ের কাছে স্যান্ডেল জোড়া দিয়ে বলে -জুতা না লেহানা আব্বা চলে যাছি, জুতা পাত দেহানা যা নাইলে তো ঠাণ্ডা লাগবে! আসপার সময় কেরোসিন তেল আর লবন লাগপে। ভেন গাড়ি আড়তের যতই কাছে যাচ্ছে রসুলের বুকে হাতুড়ি পেটার মতো ঢক ঢক শব্দ বেড়ে চলছে। শুনেছে বাজার দর পড়ে গেছে। কতোটা কমেছে তা খোজ নেয়া হয়নি। দাম যাই থাকুক বিক্রি না করে উপায় নেই। আড়তের সামনে পাকা রাস্তার পাশে কুমড়া বোঝাই করা গোটা বিশেক ভেন গাড়ি আর ট্রাক্টর দাড়িয়ে আছে। রসুল তার গাড়ি দুটি লাইনের একেবারে পিছনে রেখে মহাজনের সামনে গিয়ে দাড়ায়। জলিল মিয়া ডানে বায়ে নেড়ে চেড়ে বসে রসুলের দিকে তাকিয়ে বলে -তামাম গাধালা এক সাথে চলে আসছিস। দেশের খবর রাখিস না? দেড় মাস ঢাকায় গাড়ি চলে না। দেশত অবরোধ চলছে। তোর কুমড়া লই মুই কি করিম? এতগুলা কুমড়া কি মুই খাবার তরে লিম? - ভাইজান মুই কি করিম, কম বেশ করে আনেন, দশ বিশ টাকা কম করে লে লেন। একটু অভাবত আছিত। রসুল মিনতি করে বলে। -দশ বিশ টাকা কম বেশ কিরে ব্যাটা... এই দেখ সারি সারি খাড়ায়া আছে। পঞ্চাশ টাকা দরত মুই দেছু। রহিস, তামাম মালডা তুলু, জায়গা যদি খালি থাকে তোর মালডা লিম মুই। এক মাস পর আসিস টাকাটা ধরে যাইস। রসুলের বিষ খেয়ে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে। পকেটে বিষ কিনে খাওয়ার টাকা নেই। মাল গুদামে রেখে লাভ নেই। ফিরিয়ে না নিয়েও উপায় নেই। মহাজনের সামনে পকেটে হাত দিয়ে কাগজটা একবার বের করতে চেয়েও ভাবে, লাভ কি... মহাজনদের দয়া মায়া থাকতে নেই। এই মহাজনরাই তো দেশ চালাচ্ছে। কার বউ চিকিৎসার অভাবে মারা গেলো তা দেখার সময় কোথায়। তাদের দরকার ক্ষমতা আর টাকা। বাকী সব তুষের দরে পুড়ে মরুক। কার কি আসে যায়। কেরোসিনের খালি বোতলটা বগলে চেপে ভেন গাড়িতে বসে রসুল। মাল নিয়ে ফেরত যাচ্ছে বাড়িতে। মাল বিক্রি হোক বা না হোক ভেন গাড়ির ভাড়া তো দিতে হবে। এই টাকা কোথায় পাওয়া যাবে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্না আসছে না। যখন কাঁদার প্রয়োজন পড়ে কাঁদতে না পাড়লে খুব কষ্ট হয় রসুলের। এই কষ্ট অসহনীয় কষ্ট। সামনেই টাঙ্গন নদীর সেতু। সেতু পার হয়ে নদীর তীর ধরে ডান দিকে মাইল খানেক দূরে রসুলের বাড়ি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ঘণ্টা খানেক আগে। পূর্বের আকাশে বিশাল বড় চাঁদ। ঝলমল করছে চার দিক। শুধু রসুলের মনে অশান্তির আগুন। যেই ফসলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা সেই ফসল আজ আপদ! সেতুর উপরে উঠে লাফ দিয়ে ভেন গাড়ি থেকে নেমে পড়ে রসুল। -মজু গাড়িডা থামাইস বলে চিৎকার দেয়। দা হাতে নিয়ে কুমড়া কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলতে থাকে। এর মধ্যে গোটা দশেক ফেলে দিয়েছে। ময়জুদ্দি ছুটে এসে দুই হাতে দা ধরে রাখা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে -এইটা কি কল্লো ভাই। এই ক্ষতি কেনো কল্লো? -কুমড়ালা তোরা লে লে। মোর হাতে তোদের ভাড়ার টাকা নাই... বলে রসুল। এতক্ষণে রসুলের শরির দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। হাত থেকে সেতুর উপর কংক্রিটে দা আছড়ে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। -উঠাক, বাড়ি যাই। ময়জুদ্দি হাত ধরে টেনে তুলতে চেষ্টা করে। মুক ভাড়া দিবা হবে নি। তোর ঘরত মাল লাগায়া দিছু। বিকানোর পর শেলা টাকা দিস। না দিলে মোর মনে দুঃখ নাই। চল বাড়ি চলে যাই। বলে ময়জুদ্দি আরেক বার হাত ধরে হালকা ভাবে টান দেয়। -মুই যাম নি রে, তমা যাও। মুই পরে যাছু। -তুই থাকিস। এই বলে ময়জুদ্দি একটা বিড়ি ধরিয়ে দুই তিনটা টান দিয়ে রসুলের হাতে দেয়। রসুল বিড়িটা হাতে নেয়। ময়জুদ্দি নেপালকে বলে -গাড়ি খান চালা নেপাল। নেপাল আর ময়জুদ্দি ভেন গাড়ি টেনে রসুলের বাড়ির দিকে যেতে থাকে। চৈত্রের খরানে যখন মাটি ফাটে, ধুলা উড়ে, টাঙ্গনে স্বচ্ছ হাঁটু জলের স্রোত বয়ে চলে অবিরাম। কোথা থেকে আসে এই জল রসুল জানে না। এই টাঙ্গনের মতো ধীরলয়ে যদি সংসারটা চলতো বার মাস। মাঝে মাঝে থেমে না যেতো। টাঙ্গনের জলে সাঁতার কাটছে পূর্ণিমার চাঁদ। সেতুর নীচে টাঙ্গনের মৃদু স্রোতে চাঁদটা যেন গলে মিশে যেতে চাইছে জলের সাথে। কদম রসুল চেয়ে আছে জলে মেশা চাঁদের দিকে।
নোটঃ লেখাটিতে উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁ জেলার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতের বিহার রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের তিন কিলোমিটার ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে টাঙ্গন নদী। টাঙ্গন তীরে দেশের অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের বাস। পাঠকের সুবিধার্থে কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ তুলে ধরছি। সাটাম = জলদি, তাড়াতাড়ি। করবা হবি = করতে হবে। করছু = করছি। বোটালা কাটছু = বোঁটাগুলো কাটছি। কাটি লিম = কেটে নিবো। জুতা পাত দেহানা = জুতা পায়ে দিয়ে। তামাম গাধালা = সবগুলো গাধা। মুই কি করিম = আমি কি করবো। টাকাটা ধরে যাইস = টাকাটা নিয়ে যাস। উঠাক = উঠো। শেলা = তখন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।